IQNA

মেলানিয়া ও ইভাঙ্কাকে লেখা খোলা চিঠিতে ফিলিস্তিনি মায়ের আর্তনাদ

23:49 - March 22, 2018
সংবাদ: 2605324
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিন নিয়ে মার্কিন নীতিসমূহ ইতোমধ্যে চরম বিভেদের জন্ম দিয়েছে এবং বপন করেছে সহিংসতার বীজ। এই অবস্থায় ফিলিস্তিন শিশুদেরকে ‘সহনশীলতা’ শিক্ষা দেয়া মায়েদের জন্য কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে- তা নিয়ে ২১ মার্চ প্যালেস্টাইনের ‘মা’ দিবসে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ও ট্রাম্প কন্যা ইভাঙ্কার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠিতে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন এক ফিলিস্তিনি মা। নিচে তার চিঠির হুবহু ভাষান্তর তুলে ধরা হলো:

 

বার্তা সংস্থা ইকনা: ফিলিস্তিনে বাচ্চাদের বড় করা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠেছে। এটা কেবল শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও অত্যন্ত ক্লান্তিকর। তিন কিংবা চার বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশুরা যখন তাদের চারপাশের বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, তখন প্রতিটি ফিলিস্তিনি মাকে তাদের শিশুদের চারপাশে কি ঘটছে- তা বুঝাতে সাহায্য করার জন্য স্পষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজতে হচ্ছে।

এমনকি পশ্চিম তীর থেকে জেরুজালেম যেতেও একটি কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন হচ্ছে, বিশেষতঃ জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে ট্রাম্পের স্বীকৃতির পর এটি আরো ব্যাপকতা পেয়েছে। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব সমাধানের উপায় হিসাবে জনাব ট্রাম্প কি জেরুজালেমকে একটি উন্মুক্ত, গ্লোবাল শহর ঘোষণা করতে পারেন? চার বছর বয়সী একজন শিশুর কাছে আপনি এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা কিভাবে দিবেন?

২১ মার্চ প্যালেস্টাইনে ‘মা’ দিবস হিসেবে উৎযাপিত হয়। এই দিবসে আমি আপনাদের (মেলানিয়া এবং ইভাঙ্কা) কাছে এই বিষয়ে লিখছি।

একজন সচেতন মা তার পরিবারে কখনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস চাপিয়ে দেন না। একইভাবে, আমরা সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং অকপটতাকে সমর্থন করে থাকি। আমরা আমাদের শিশুদের তাদের চারপাশের কোনো কিছু দেখা থেকে বিরত রাখতে পারি না। আমাদের শিশুরা গেমস এবং ইন্টারনেট উপভোগ করে, সন্তের দিবস ‘হ্যালোইন’ উদযাপন করে এবং স্কুল-কলেজের ‘প্রম’ অনুষ্ঠানে নাচে। সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্বব্যাপী মানুষকে সংযুক্ত করেছে এবং আজকের দিনে শিশুদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় কার্যকলাপটি হচ্ছে ‘আবিষ্কার করা’।

আমরা আমাদের বাচ্চাদের ‘ইস্টার’ এবং ‘আধার’ এর মতো ইহুদি অনুষ্ঠান ‘হানুক্কা’কে শ্রদ্ধা করতে শিক্ষা দেই। একটি জাতি বা ধর্ম অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ- এই শিক্ষা প্যালেস্টাইনের শিশুরা শিখে না। কিন্তু জনাব ট্রাম্প তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমাদের সরল অকপটতাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তার এই ঘোষণা আমাদের বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের সন্তানরা স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার বিদ্বেষমূলক সহায়তা বন্ধ এবং জেরুজালেম ঘোষণার বিষয়টি ঘৃণার চোখে দেখছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্তগুলো কেবল রাজপথে ঘৃণা ছড়ানো এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলি নিষ্ঠুর আক্রমণ ছাড়া আর কিছু আনতে পারেনি।

ইসরাইল কর্তৃক শত শত ফিলিস্তিন শিশুকে গ্রেপ্তার, সহিংস অভিযান এবং গাজায় বোমা হামলা সম্পর্কে আমার বাচ্চারা আমাকে এটা্ বলতে বাধ্য হয়েছে যে, ‘আমরা ট্রাম্পকে ঘৃণা করি এবং আমরা ইহুদিদের ঘৃণা করি - কারণ ওরা আমাদের স্বপ্নগুলোকে ধ্বংস করছে, আমাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে’। যখন আমি আমার বাচ্চাদের কাছ থেকে এই কথাগুলো শুনছিলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম যে, আমাকে আমার পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঘৃণ্য রাজনীতি মোকাবিলা করতে হয়েছে।

ধর্মে মায়েদেরকে সত্য বলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাতের বেলায় ইসরাইলি সৈন্যরা আমাদের শহরে ঢুকতে পারে কিনা এবং যে কোনো সময়ে আমাদের ক্ষতি করতে পারে কিনা- আমাদের বাচ্চারা এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করা পর্যন্ত তা ঠিক ছিল। আমি তাদের ‘হ্যাঁ’ বলতে চাইনি, কিন্তু একজন ফিলিস্তিনি মা হিসাবে আমি তাদের কাছে দখলদারিত্বের বাস্তবতা লুকিয়ে রাখতে পারিনি।

তাই আমি তাদেরকে সত্য বলেছি। একজন মা হিসাবে, আমি আমার বাচ্চাদের কাছে আমার বিশ্বাস হারাতে চাই নি। কিন্তু একই সময়ে, তারা যে শুধুই শিশু- এই বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা করাও বন্ধ করতে পারিনি। তারা একটি উপযুক্ত শৈশব পাওয়ার যোগ্য এবং চলমান সকল সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা থেকে দূরে থাকার অধিকার রাখে।

আমি সাধারণত আমার বাচ্ছাদের নিয়ে বছরে একবার হলেও জেরুজালেম সফর করি। বাচ্চাদের নিয়ে জেরুজালেম পরিদর্শনে ‘নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য’ বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। জেরুজালেমে প্রবেশের পরিকল্পনার প্রথমেই ইসরাইলের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হয় এবং ভাগ্যবান হলে এর জন্য অন্তত কয়েক সপ্তাহ পর অনুমতি মেলে, অন্যথায় বছরও লেগে যেতে পারে। তারপর আমাদেরকে একটি ট্যাক্সির বুকিং নিতে হয়- কারণ পবিত্র শহরটিতে আমাদের নিজস্ব গাড়ি নিয়ে প্রবেশের দেয় না ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।

মেলানিয়া এবং ইভাঙ্কা, আপনারা হয়ত অবগত নন যে, জেরুজালেম যাওয়ার অর্থ হচ্ছে- আপনাকে কুখ্যাত ‘কুয়ালান্দিয়া’ চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে হবে, যেটি জেরুজালেম থেকে রামাল্লাকে আলাদা করেছে। ‘কুয়ালান্দিয়া’ হচ্ছে সেই কুখ্যাত বিরোধপূর্ণ অঞ্চল, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী বেসামরিক নাগরিকদের ওপর টিয়ার গ্যাস এবং লাইভ গোলাবারুদ ব্যবহার করে; যারা প্রতি শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণার প্রতিবাদে জড়ো হয়।

আমার বাচ্চাদের কাছে এটাকে আপনারা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে বলবেন? আপনারা কি চান যে আমি তাদেরকে অন্যায় সহ্য করতে এবং নতুন মার্কিন নীতিসমূহ গ্রহণ করার শিক্ষা দিই? যে নীতিসমূহ আরো সহিংসতা, রক্তপাত এবং প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটিয়েছে, তা কেমন করে তাদের মেনে নেয়ার শিক্ষা দেব?

আমি শুধু একজন প্রকৃত ফিলিস্তিনি মায়ের এক উদাহরণ; যারা তাদের বাচ্চাদের এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে যত্ন নেয়। আমি কেবল হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মায়েদের একজন; যারা তাদের শিশুদেরকে একজন মেধাবী ও আত্মবিশ্বাসী ফিলিস্তিনি শিশু হিসেবে বড় করতে চান।

মাতৃত্ব হচ্ছে অনেকটা সর্বজনীন। অন্য সব মায়েদের মতোই প্যালেস্টাইনি মায়েরা এটা নিশ্চিত করতে চায় যে ২০, ৪০ এবং ৬০ বছর বয়সে তাদের বাচ্চারা নিরাপদ থাকুক। আমার সন্তান সবসময়ই আমার সন্তান হবে, এমনকি ৯০ বছরেরও বেশি বয়স হলেও!

মিসেস ট্রাম্প, আমার অবস্থানে নিজেকে কল্পনা করুন। আপনি হলে কি করতেন?

লেখক: ড. দিলাল এরাকাত। তিনি প্যালেস্টাইনের আরব-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধ নিষ্পত্তি, কূটনীতি ও কৌশলগত পরিকল্পনা বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। একই সঙ্গে তিনি আল কুদস পত্রিকার একজন সাপ্তাহিক কলামিস্ট এবং ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কৌশলগত যোগাযোগ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সমাজে পরিবর্তন আনয়ন সম্পর্কে উত্সাহী। আরটিএনএন

 

captcha