IQNA

চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের সত্যতা পেয়েছে জাতিসংঘ

21:17 - October 16, 2018
সংবাদ: 2607015
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উইঘুর মুসলিমদেরকে তথাকথিত ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে জোরপূর্বক আটকের প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা ভাবনা করছে।

চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতনের সত্যতা পেয়েছে জাতিসংঘবার্তা সংস্থা ইকনা: কিন্তু চীনের মুসলিমদের বাস্তবিক অবস্থা আসলে কি? সেখানে কি আদৌ ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রের অস্তিত্ব রয়েছে?

চীনের বিভিন্ন ধর্ম যেমন-বুদ্ধইজম, তাওইজম, ক্যাথলিজম এবং প্রোটেস্টানইজম ইত্যাদি ধর্মের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ইসলাম দেশটির ‘বড় একটি ধর্মের’ মর্যাদা লাভ করেছে। কিন্তু চীনের ১৯৮২ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র এসকল ধর্মের প্রার্থনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে।

চলতি বছরের শুরুতে চীন সরকার দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়ে একটি প্রবন্ধ উন্মুক্ত করে যেখানে ইসলাম ধর্মের কথাও বলা হয়েছে। চীন সরকারের সেই প্রবন্ধের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে ২০ মিলিয়নেরও অধিক মুসলিমের বসবাস। পাশাপাশি চীনে ৫৭,০০০ জন মুসলিম বিশেষজ্ঞ এবং ৩৫,০০০টি মসজিদ রয়েছে। এমনকি দেশটিতে ১০ টি ইসলামিক বিদ্যালয় রয়েছে।

চীন সরকারের প্রবন্ধটিতে মুসলিমদের বিভিন্ন সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন- খাদ্যাভ্যাস,পানীয় পানের রীতি,পোশাক পরিধান, উৎসবসমূহ, বিয়ে এবং দাফন-কাফন ইত্যাদি।

সরকারী তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে মুসলিমদের এসব সংস্কৃতিকে খুবই শ্রদ্ধার সাথে দেখা হয়। এমনকি ইসলামিক এ্যাসোসিয়েশন অফ চায়নার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতি বছর ১০,০০০ জন চীনা মুসলিম সৌদি আরবে পবিত্র হজ্জ পালন করতে যান।

ধর্মীয় মৌলবাদ এবং বিদেশি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ

চীন সরকারের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক প্রবন্ধ অনুযায়ী, চীনা সমাজ ধর্মীয় বিভিন্ন রীতি নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা এসব ধর্মীয় নীতিকে দেশপ্রেম, শান্তি, ঐক্য, সহনশীলতা এবং মধ্যপন্থা হিসেবে দেখে থাকেন।

চূড়ান্তভাবে ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয় যে, চীন সরকার দেশটিতে অবস্থিত বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো মজবুত করার জন্য ‘সমর্থন এবং উৎসাহ’ দিয়ে যাচ্ছে।

জাতিগত নিধন

চীনের মুসলিমদের মধ্যে অধিকাংশই হুই মুসলিম (প্রায় ১০.৫ মিলিয়ন)। এ সমস্ত আদিবাসী চীনারা বিশেষত চীনের উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের প্রদেশ নিনজিয়াং, গুয়ানসু এবং ইউননানে বসবাস করে থাকেন।

অন্যদিকে উইঘুর চীনারা যাদের আদি পুরুষ ছিল তুরস্ক থেকে চীনে এসেছিল, তারা দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশ জিয়ানজিয়াং এ বসবাস করেন। এরা চীনের মুসলিম অধিবাসীদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম(প্রায় ১০ মিলিয়ন)।

১৯৪৯ সালের চীনের গৃহযুদ্ধে কমিউনিস্টদের বিজয় লাভের পর দেশটিতে বসবাসরত বিভিন্ন মুসলিম সম্প্রদায় দমন পীড়নের শিকার হয়েছিল। তাদেরকে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বিভিন্ন মসজিদ একেবারে ধ্বংস করে দেয়া হয়।

তবে মাও শেতুং এর মৃত্যুর দুবছর পর ১৯৭৮ সালে চীনা নেতৃত্ব দেশটিতে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

উইঘুর মুসলিমদের ইস্যু

চীন সরকার কর্তৃক জিয়ানজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত উইঘুর মুসলিমগণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি এবং সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত রয়েছেন এমন অভিযোগ আনা হয়। এমনকি উইঘুর মুসলিমরা তুরস্কের সমর্থনে উইঘুর জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামিক ধর্মান্ধতার সাথে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ এনে চীন সরকার তাদেরকে দমনের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়।

সময়ের সাথে সাথে জিনজিয়াংসহ চীনের অন্যান্য অঞ্চলে উইঘুর জাতীয়তাবাদ এবং ইসলাম-ইজম ছড়িয়ে পড়ে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন সংঘর্ষের মাধ্যমে। এমনকি দেশটিতে গোলাগুলি, বোমা ফাটানো,ছুরি দিয়ে আক্রমণ এবং গাড়ি হামলার মত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে।

২০০৯ সালে জিনজিয়াং এর রাজধানী উরুমকিতে উইঘুর মুসলিমদের একটি দল সেখানে অবস্থিত একটি কারখানায় বিদ্রোহ শুরু করে। ফলাফল স্বরূপ সেখানে ১৯৭ জন নিহত এবং অন্তত ১,৫০০ জন উইঘুর মুসলিম গ্রেপ্তার হন।

এর পূর্বে ১৯৯২ এবং ১৯৯৭ সালে উরুমকিতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এর পরে ২০১০ সালে আকসু নামক স্থানে বোমা হামালা,২০১১ সালে গুয়ানজুতে হামলা এবং ২০১৬ সালে কিরগিজস্তানে চীনের দূতাবাসে গাড়ি হামলা চলানো হয়।

এমনকি সিরিয়া যুদ্ধে অন্তত ১০,০০০ জন উইঘুর সালাফি জিহাদি সেখানকার নুসরা ফ্রন্টে যোগ দিয়েছে বলেও জানা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক দীক্ষা কেন্দ্র?

২০১৭ সালের শেষের দিকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, হাজারেরও বেশী উইঘুর মুসলিমকে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে বিভিন্ন আটক কেন্দ্রে আটক রাখা হয়েছে। এ সমস্ত আটকাদেশ তিন মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। আটক থাকাকালীন উইঘুরদের জোর পূর্বক ম্যান্ডারিন ভাষা শিক্ষা দেয়া হয় এবং পাশাপাশি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ কর্তৃক একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়- Human Rights Watch, Amnesty International, the exiled World Uyghur Congress সহ বিশ্বের অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন সমূহের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে, চীন সরকার মিলিয়নেরও বেশী উইঘুর মুসলিমদেরকে এসব ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ দান কেন্দ্রে আটক করে রেখেছে। জাতিসংঘ বেইজিংকে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন চালানোর দায়ে অভিযুক্ত করে।

জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুসলিমদের জন্য তৈরি করা এসব ‘দীক্ষা দান’ কেন্দ্রে মুসলিমদেরকে আটক রেখে নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি তাদেরকে কমিউনিস্ট পার্টির অনুগত করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয়।

তবে চীন সরকারের কর্মকর্তাগণ জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনকে সত্যের বিপরীত বলে আখ্যায়িত করেছেন। চীনে জাতিসংঘের দাবীকৃত কোনো ‘রাজনৈতিক দীক্ষা’ কেন্দ্র নেই বলেও তারা দাবী করেছেন। স্পুটনিক নিউজ

captcha