একজন ঈমানদার এক, অদ্বিতীয় ও অমুখাপেক্ষী স্রষ্টায় বিশ্বাস করে—যিনি কারো থেকে জন্মগ্রহণ করেননি এবং কাউকে জন্ম দেননি। আর কেউ তার সমকক্ষও নয়। সব সৃষ্টি তার জন্য এবং সৃষ্টিজগতের কর্তৃত্বও তার জন্য। আসমান-জমিনের রাজত্বও শুধু তাঁর।
ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত কে এম পানিক্কর ভারতবর্ষের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মীয় অঙ্গনে ইসলামের একত্ববাদের প্রভাব সম্পর্কে বলেন, ‘এটা সুস্পষ্ট ও সুস্থির বিষয় যে ইসলামী শাসনামলে ভারতবর্ষের ধর্মচর্চায় ইসলামের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ভারতে আল্লাহর ইবাদত (একেশ্বরের উপাসনা) মুসলিম প্রবর্তিত। এ যুগের বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মীয় নেতৃত্ব যদিও তাদের উপাস্যদের নানা নামে সম্বোধন করত, তবে তারা আল্লাহর ইবাদত (একেশ্বরের উপাসনা)-এর আহ্বান জানাত। তারা স্পষ্টত বলত, উপাস্য একজনই। তিনিই শুধু উপাসনার যোগ্য। তার কাছেই মুক্তি ও সাফল্য প্রার্থনা করা হবে। ভারতবর্ষের ধর্মীয় জীবনে এই প্রভাব তৈরি হয়েছে ইসলামী যুগেই।’ (অ্যা সার্ভে অব ইন্ডিয়ান হিস্টোরি, পৃষ্ঠা ১৩২)
সামাজিক জীবনে মুসলমানের সবচেয়ে বড় উপহার ছিল ‘মানবিক সাম্য’, যা তৎকালীন ভারতীয় সমাজে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল। ইসলাম যে সাম্যের বার্তা ভারতবাসীকে দিয়েছিল সেখানে জাত-বর্ণের বিচার ছিল না, জন্মসূত্রে কেউ পবিত্র বা অপবিত্র ছিল না, শিক্ষার অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত ছিল না, পেশা ও কর্মের বিচারেও কোনো বিভেদ ছিল না। তারা সবাই একত্রে জীবনযাপন করত, একসঙ্গে খেত, একসঙ্গে শিক্ষাগ্রহণ করত এবং স্বাধীনভাবে পেশা গ্রহণ করত। যদিও তা ভারতীয় চিন্তাধারা ও সমাজকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল; কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই তা দ্বারা ভারতবর্ষ বহুভাবে উপকৃত হয়েছিল। কঠোর সামাজিক বৈষম্য ও বর্ণপ্রথাকে শিথিল করতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। ‘অস্পৃশ্যতা’র দেয়াল ভেঙে সমাজসংস্কারের সূচনা করেছিল। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরু ঐতিহাসিক এই সত্যের স্বীকৃতি দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে যেসব যোদ্ধাকে ভারতে প্রবেশ এবং ভারতে মুসলিম আগমন ভারতবর্ষের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সমাজে যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়েছিল তারা তা দূর করেছে। তারা প্রকাশ করে দিয়েছে বর্ণপ্রথা, অস্পৃশ্যতার রীতি এবং পৃথিবীতে বিচ্ছিন্নতার নানাদিক—ভারতবাসী যার ভেতর বসবাস করত। নিশ্চয়ই ইসলামের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের নীতি মুসলিমরা যা বিশ্বাস করত এবং জীবনে ধারণ করত ভারতীয় চিন্তাধারায় তা গভীর প্রভাব ফেলে। এর দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিল শূদ্ররা (হিন্দু সমাজ কাঠামোর চতুর্থ শ্রেণি)। ভারতীয় সমাজ যাদের সাম্য ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল।’ (দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, পৃষ্ঠা ৩৩৫ ও ৫২৬)
ভারতবাসীর জন্য মুসলিমদের তৃতীয় উপহার ছিল নারীর প্রতি সম্মান এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি। ইসলাম তাকে মানবসমাজের সম্মানিত সদস্য ও পুরুষের সহোদর মনে করে। তারা এই অমূল্য উপহার এমন দেশের জন্য বয়ে এনেছিল, যেখানে উচ্চবংশীয় নারীরা স্বামীর মৃত্যুর পর আগুনে আত্মাহুতি দিত। তারা নিজেরাও এবং সমাজও মনে করত স্বামীর মৃত্যুর পর তাদের জীবনধারণের কোনো অধিকার নেই। এ দেশের জন্য এটা কত বড় উপহার ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আল-মুসলিমুনা ফিল-হিন্দ, মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর