IQNA

শ্রীলংকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতায় ইন্ধন দিচ্ছে ঘৃণাত্মক বক্তৃতা ও দায়মুক্তি

0:33 - March 11, 2018
সংবাদ: 2605238
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলীয় শান্তিপূর্ণ পাহাড়ি শহর ক্যান্ডির সর্বশেষ মুসলিম-বিরোধী সহিংসতার ঠিক আগের দিন সিংহলি জাতীয়তাবাদী গ্রুপের নেতা অমিত বীরাসিংহ শহরটির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন।



বার্তা সংস্থা ইকনা: ‘আমরা লিফলেট বিতরণ করছি এবং এখন দিগানায় পৌঁছেছি’, অমিত তার মোবাইল ফোনের লাইভ ভিডিওতে বলছিলেন। ‘কিন্তু সমস্যা হলো আমরা ২০টি দোকানও পাইনি যার মালিক সিনহালিরা।’

আরো ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বলতে থাকলেন, ‘এই শহরটি নিয়ন্ত্রণ করে মুসলমানরা। আসলে এই বিষয়টি আমাদের আরো অনেক আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল।’

এরপর তিনি বললেন, ‘আমরা সিনহালিরাই এর জন্য দায়ী। দিগানা কিংবা এর আশপাশে যদি কোনো সিনহালি থাকেন তাহলে এখানে আসেন, প্লিজ।’

তার এই ভিডিওটি ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারে পোস্ট করার পর ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়।

আর এর ফল যা হওয়ার কথা তাই হলো। ক্যান্ডি জেলার দিগানায় মুসলমানদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমনকি মসজিদে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হলো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশটির সরকারকে সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি জরুরি অবস্থা ঘোষণা, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করতে হলো।

সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুসলমানদের পিটুনিতে এক সিনহালিজ মারা গেছে এমন অভিযোগ থেকেই ওই সহিংসতার শুরু হয়। সহিংসতার ফলে কমপক্ষে দুইজন নিহত এবং মসজিদ ও বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আহত হন বেশ কিছু মুসলমান।

এ ঘটনা আবারও শ্রীলঙ্কায়, যে দেশটি প্রায় তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে, অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দেয়।

তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সরকারের ওই গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে ২০০৯ সালে। এই ঘটনা নতুন করে দেশটিতে অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে, কারণ এটি ধর্মীয় বিভেদ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনহালিজ বৌদ্ধ, যারা দেশটির প্রায় ৭৫ শতাংশ, এবং মুসলমানদের, যারা দেশটির দুই কোটি ১০ লাখ লোকের প্রায় ৯ শতাংশ, মধ্যে বিভেদ তৈরির চেষ্টা।

বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুগ যুগ ধরে এই দুটি সম্প্রদায় দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রীতির সঙ্গেই বাস করছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সিনহালিজরা বলছে, তারা অনিরাপদ বোধ করছে। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে দেশটির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে সিনহালিজ বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদের বিদ্বেষপূর্ণ অবস্থান আরো শক্ত হয়েছে।

কলম্বোভিত্তিক ন্যাশনাল পিস (শান্তি) কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক জেহান পেরেরা বলছেন, মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব অনেক বেড়েছে, কারণ সিনহালিরা ঐতিহাসিকভাবেই নিজেদের হুমকিগ্রস্ত সম্প্রদায় হিসেবে মনে করে।

তিনি বলছেন, তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একটি বিরাট জনসংখ্যা হিসেবে দেখা হতো, কারণ তাদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের তামিলদের সংযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের কারণে সেখানকার মুসলমানদেরও একটি শক্তিশালী গ্রুপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তারা (সিনহালিজ) মনে করছে, তারা (মুসলমানরা) একদিন শ্রীলঙ্কার ক্ষমতায় বসবে।

এই বিশ্বাসের কারণে আতঙ্ক তো আছেই। তার ওপর মুসলমানদের সংখ্যা ‍বৃদ্ধি এবং মুসলমানরা জন্ম নিরোধকের মাধ্যমে সিনহালিদের সংখ্যা হ্রাসের পরিকল্পনা করছে- এমন মিথ্যা গুজব ছড়ানোর কারণে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব আরো বাড়ছে।

ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির পূর্বাঞ্চলে এমনই এক গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। সেখানকার এক মুসলিম পাচকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি খাদ্যের মধ্যে স্টেরিলাইজেশন পিল (সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করা) মিশিয়ে সিনহালি গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছেন।

পেরেরা বলছেন, ‘ওই ঘটনা ছিল পুরোপুরি মিথ্যা এবং বানানো গল্প।’

মুসলিম কাউন্সিল অব শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নিজামুদ্দিন মোহাম্মাদ আমীন বলছেন, সিনহালিজরা মনে করেন, মুসলমানরা অর্থনৈতিকভাবেও অনেক শক্তিশালী। আর এমন ধারণা করায় তাদের মধ্যে মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব বাড়ছে।

তিনি বলছেন, ‘এটি একটি মিথ (সাজানো গল্প)। অনেক শহরে ছোট ছোট দোকানদার মুসলমানরা। তারা ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যবসায়িক লোক। কিন্তু তাদের ব্যবসা অনেক ছোট, প্রতিদিন কেনা-বেচা ধরনের।’

আমীন ও পেরেরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও এই প্রতিহিংসার অন্যতম কারণ।

পেরেরা বলছেন, ‘দশ লাখের বেশি শ্রীলঙ্কান বিদেশে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন। আর এক্ষেত্রে অনেকটা মুসলমানরাই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এর ফলে তারা দেশে অর্থ আনছেন। তাছাড়া যখন তারা দেশে আসছেন তখন আরব সংস্কৃতির কিছু দিকও আমদানি করছেন।’

তিনি বলছেন, ‘এভাবে আরব দেশগুলো থেকে অনেক অর্থ আসছে, মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে। সেইসঙ্গে অনেক মুসলিম নারী ভিন্ন পোশাক- নিকাব- পরছেন যেটা তারা আগে করতেন না।’

পেরেরার মতকে সমর্থন করে আমীন বলেন, ‘আমাদের মায়েরা চুল ঢেকে কাপড় পরছেন, কিন্তু নিকাব পরছেন না। মুসলমানদের পোশাক-আশাকে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তারা (সিনহালিজ) মনে করছে, তারা (মুসলমান) সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব দেশের আদর্শ অনুসরণ করছে।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সিনহালিজ জাতীয়তাবাদী গ্রুপের সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের বিশ্বাস ও গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে।

আলজাজিরার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী গ্রুপ এসব ছড়াচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো- বীরাসিংহের মাহাসন বালাকায়া এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু গালাগোদা আত্তে জিনানাসার বোদু বালা সেনা (বিবিএস)। এর মধ্যে বিবিএসের সঙ্গে মিয়ানমারের বৌদ্ধ উগ্রপন্থী গ্রুপ মা বা থা’র যোগাযোগ রয়েছে।

পেরেরা বলছেন, বিবিএস ও মাহাসন বালাকায়া যদিও অতটা জনসমর্থন পায় না। কিন্তু তাদের কিছু কিছু মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাব অধিকাংশ সিনহালিজ বৌদ্ধরা সমর্থন করে।’

অন্যান্য অ্যাক্টিভিস্টরা বলছেন, এই সব গ্রুপ তাদের উস্কানি ও ঘৃণ্য বক্তব্যের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত করছে। অথচ প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সরকার তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

উদাহরণস্বরূপ ২০১৪ সালের জুন মাসের কথা বলা যায়। তখন দেশটির আলুথগামায় যে মুসলিমবিদ্বেষী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য জিনানাসারার বক্তব্যকে দায়ী করা হয়। ওই দাঙ্গায় চারজন নিহত এবং অন্তত ৮০ আহত হয়। কিন্তু তারপরও সে সময় তাকে আটক করেনি প্রশাসন।

এরপর ২০১৭ সালে আদালতে বক্তব্যের পক্ষে যথাযথ যুক্তি দেখাতে না পারায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান। ওই মামলা এখনও চলছে।

ক্যান্ডির ঘটনায় লঙ্কা সরকার বীরাসিংহ ও তার নয় সহযোগীকে আটক করেছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এটি দেরিতে নেওয়া খুবই সামান্য পদক্ষেপ।

দেশটির মানবাধিকার কর্মী থিয়াগা রুওয়ানপাথিরা বলছেন, বীরাসিংহের আটক যথাযথ নয়। তিনি বলেন, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই জনগণের উদ্দেশ্যে বলা দরকার যে, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা মেনে নেওয়া হবে না এবং বিশেষ কোনো জাতিগোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই শুধু দেশের ওপর অধিকার আছে, অন্যদের নেই- বিষয়টা এমন নয়। আল জাজিরা

 

captcha